আর রাহীকুল মাখতুম ( সংক্ষিপ্ত-রিভিউ )
পর্ব -১
খ্রিস্টপূর্ব
২৫০০ অব্দে আরবে মুস্তারিবা গোত্রের পূর্ব পুরুষ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ইরাকের “আর” শহরের অধিবাসি ছিলেন। এটি ইউফ্রেটিস
নদীর পশ্চিম তীরে কুফার কাছাকাছি একটি শহর। ইব্রাহীম আঃ সেখান থেকে হারানের দিকে দ্বীন
প্রচারের উদ্দেশ্যে হিজরত করেন ও পরে ফিলিস্তিন হিজরত করেন এবং ফিলিস্তিন হয় দাওয়াতের
মারকাজ । তিনি এই শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন।
অত্র
গ্রন্থের লেখক মাওলানা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) মশহুর সেই গঠনাটি উল্লেখ করেন-যেটি
ছিল একটি সফর, সাথে ছিলেন বিবি সারা (আঃ) । ঘটনাক্রমে এক বাদশাহর হাতে উভয়ে ধরা পড়েন।
বাদশাহ বিবি সারার দিকে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থে হাত বাড়ায়- সারা আঃ আল্লাহর কাছে দুয়া
করেন, ফলে তার হাত শরীর অবস হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে
থাকতে হয়। বাদশাহ বুঝতে পারল তিনি নেককার নারী,
বাদশাহ তখন ভয় পেয়ে গেল এবং সারা আঃ এর সম্মানার্থে তাঁকে একটি খাদেমা দান করেন -যার নাম ছিল
হাযেরা (আঃ)। বিবি সারা (আঃ) সেই বাদীকে ইব্রাহীম (আঃ) কে হাদিয়া দেন, ইব্রাহীম (আঃ)
হাযেরা (আঃ) কে বিয়ে করেন । হাযেরা আঃ হতে ইসমাইল আঃ এর জন্ম হয় যদিও সারা আঃ এর তখনো
কোন সন্তান হয়নি। নবী ইবারাহীম আঃ আদেশপ্রাপ্ত হয়ে হাযেরা আঃ কে শিশুপুত্র ইসমাইল আঃ
সহ জনমানবশূন্য মরু এলাকা- হেযাজের মক্কা তে রেখে আসেন, সাথে সামান্য পানি ও খেজুর
দিয়ে। ইব্রাহীম আঃ তাঁর দাওয়াতের কাজে চলে যান। রসদ শেষে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়।
ফলে আল্লাহ তায়ালা যমযম কুপের ব্যবস্থা করেন-ঘটনাটি আমরা সবাই জানি। যমযম কুপকে ঘিরে
সেখানে বসতি গড়ে উঠে এবং হাযেরা (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ) হয়ে উঠেন মক্কায় অত্যন্ত সম্মানিত
ব্যক্তি। বংশ পরম্পরায় ইসমাইল (আঃ) থেকেই জন্মগ্রহণ করেন খতেমুন্নবি হযরত মোহাম্মদ
মস্তুফা (সাঃ)- আমাদের এই আখেরি নবীর আলোচনাই করেছেন অত্র গ্রন্থে (আর রাহীকুল মাখতুম) মাওলানা সফিউর
রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ।
১.
আরবের মাটি ও মানুষ, সরকার ও প্রসাশন এবং ধর্ম ও সমাজঃ
১.১
আরবের ভৌগলিক পরিচিতি ও প্রাচীন জনপদ
এটি মুলতঃ জাজিরাতুল আরব নামে খ্যাত যার পশ্চিমে রয়েছে লোহিত সাগর ও সিনাই উপদ্বীপ, পূর্বদিকে আরব উপসাগর এবং ইরাকের কিছু অংশ । দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের এক অংশ- আরব সাগর। উত্তরে সিরিয়া ও জর্ডান আর ইরাকের কিছু অংশ – যার মোট আয়তন মতভেদে ১০ থেকে ১৩ লক্ষ বর্গ-কিলোমিটার। এর চারিদিকে মরুভূমি, শক্ত মাটি আর বালুকারাশির কারণে কেউ আরবকে জয় করতে পারেনি-তারা স্বাধীন ভাবে জীবন-যাপন করেছে সুদীর্ঘ কাল।
মুহতারাম
লেখক বলেন- উত্তরপশ্চিম প্রান্তে লোহিত সাগরের অপর পাড়ে ছিল আফ্রিকা মহাদেশ, উত্তর-পূর্ব
অংশ ইউরোপের দরজা, পূর্বে ছিল আজম এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া, দূরপ্রাচ্যের সাথেও এর
যোগাযোগ ছিল অবারিত। তদুপরি, সমুদ্রপথে প্রত্যেক মাহাদেশের সাথে তার যোগাযোগ ছিল ভাল।
এভাবে এটি ছিল একাধারে ব্যবসা কেন্দ্র, সভ্যত- সংস্কৃতি, ধর্ম-দর্শন এবং জ্ঞান -বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি আদান-প্রদানের কেন্দ্রবিন্দু।
১.২
জাজিরাতুল আরবের জাতিগোষ্ঠীঃ
সম্মানিত
লেখক এখানে তিন প্রকারের জাতিগোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন। তিনি এখানে হুজুর সাঃ এর বংশ বর্ণনার পাশাপাশি উনার আমলে যে সকল জাতির আলোচনা কোরআনে, হাদিসে ও ইতিহাসে রয়েছে তা সুন্দরভাবে তুলে ধরায় সচেষ্ট ছিলেন।
১।
আরবে বায়িদা- বিলুপ্ত জন-গোষ্ঠি- আদ [১], সামুদ [২], তাসাম, জাদিস, আমালিক,
জুরহুম [৩], হাজুর, ওয়াবার, আবীল, জাসিম, হাজরা-মাউত ইত্যাদি।
২।
আরবে আরীবা- এরা কাহতানি আরব নামে পরিচিত। এদের পীঠস্থান ইয়েমেন। সাবা বিন ইয়াশজুব
বিন ইয়ারুব বিন কাহতানের সন্তান থেকে এ বংশ-ধারা [৪] বিকশিত হয়েছিল। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ
জাতি গোষ্ঠী- হিময়ার বিন সাবা (কুযআ, সাকাসিক, যায়েদ আল জমহুর ) ও কাহলান বিন সাবা
(আযদ এবং এর শাখাসমুহ-আউস, খাজরাজ, কুযআ, আর জাফনার বংশধররা গাসসানি নামে পরিচিত)।
আযদরা ইয়েমেনের বিভিন্ন শহরে হিজরত করেন। আযদের শাখাসমুহ আরবের বিভিন্ন দিকে হিজরত
করেন। এর মধ্যে সা’লাবা বিন আমর মুযাইকিয়া হিজরত করে হিজাজের দিকে চলে যান। সা’লাবার
কয়েকটি শাখা গোত্রের মধ্যে-হারেসা বিন সালাবার দুই পুত্র হল আউস ও খাজরাজ যে দুটি গোষ্ঠী
হুজুর সাঃ এর হিজরতের সময় মদিনাতে ছিল। অন্যদিকে হারেসা বিন আমর খুজাঈ এক সময় হারাম
বিজয় করে। জুরহুমীরা ইয়েমেন থেকে মক্কায় আসে এবং তারা হাযেরা আঃ ও ইসমাঈল আঃ এর অনুমতি ক্রমে মক্কায় জমজম কুপের কাছে বসবাস
করে। ইসমাঈল আঃ এই গোত্রে বিয়ে করেন- বংশের সুচনা করেন। আরবে আরিবার আরো গোত্র- পূর্ব
ও উত্তরে লখম ও জুযাম গোত্র-যেটির একজন ছিলেন নসর বিন রবীআ যিনি হিরার মুনযিরী স্ম্রাটদের
জনক। আরেক গোত্র উত্তর দিকে-বনু তাঈ যারা আজা ও সালামা নামক দুই পাহাড়ের মাঝখানে স্থায়ী
আবাস গড়ে তুলেছিল-যেটি বর্তমানে তাঈ পাহাড় নামে খ্যাত আছে। অন্যদিকে, কিন্দা গোত্র ছিল বাহরাইনে,
যারা নযদে গিয়ে শক্তিশালি রাস্ট্র গঠন করে-কিন্তু, সেটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
৩।
আরবে মুস্তারিবাঃ
যদিও মুলত ইসমাঈল আঃ ছিলেন আরবে মুস্তারিবা গোত্রের-
যেটি কুফার নিকটে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে অবস্থিত “আর” গোত্রের ইব্রাহিম আঃ এর ঔরসজাত সন্তান।
এখানে মুহতারাম লেখক সম্ভবত মক্কার খুজাঈ এবং মদিনার আউস ও খাজরাজ এর উৎস দেখানোর উদ্দেশ্যে
উপরোক্ত বর্ণনাটি করেন।
৩.১
ইব্রাহীম আঃ এর মক্কায় গমনাগমনঃ
১ম
বার- ইব্রাহীম আঃ মক্কায় শিশুপুত্র ইসমাইল আঃ এবং হাযেরা আঃ কে দেখতে আসেন। স্ত্রীর
মনে কত কথা জমে ছিল- কত আবেগ-প্রবন হয়েছিলেন -যা ভাষায় বর্ণনা করা দুরূহ ব্যপার। তিনি
সবপ্নে আদিষ্ট হয়েছিলেন শিশুপুত্র ইসমাইল আঃ কে কোরবানি করতে। তিনি তার পুত্রকে এ স্বপ্ন
বলায় তিনি আল্লাহর হুকুম পালনে রাজি হয়ে যান এবং বলেন পিতা- আপনি তাই করুন যা আপনি
আল্লাহর কাছ থেকে প্রত্যাদেশ পেয়েছেন-নিশ্চয় আমাকে ধৈরযশীলদের মধ্যে পাবেন। ( সুরা
সাফফাত, ১০২-১০৫ দ্রঃ) এটি মুলতঃ ছিল আরেকটি কঠিন পরীক্ষা।[৫] যখন নবী ইব্রাহীম আঃ
কোরবানি সম্পন্ন করলেন, আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ছেলে কোরবানি হয়নি বরং একটি পশু কোরবানী হয়েছে
।
২য়
বার- [৬] এবার যখন তিনি মক্কায় আসেন তখন শুনতে পান তার প্রিয়তম স্ত্রী হাযেরা আঃ আর
বেচে নেই। ইয়ামেন থেকে মক্কায় আগমন কারি জুরহাম কবিলা তাদের এক কন্যা কে ইসমাইল আঃ
এর সাথে বিবাহ দেন। মক্কায় ইসমাইল আঃ ছিলেন না। ইব্রাহিম আঃ তার পুত্রবধুকে তাদের অবস্থা
সম্মন্ধে জানতে চাইলে পুত্রবধু তাদের দারিদ্র ক্লীস্ট জীবনের অভিযোগ করেন। তখন নবী
ইব্রাহীম আঃ বলে আসলেন- ইসমাইল আসলে বলবেন যে তার পিতা তার ঘরের চৌকাঠ টি বদলে ফেলতে
বলেছেন। ইসমাইল আঃ বাড়িতে আসলে বিবি তার পিতার কথাটি বলায় পুত্র এই কথার উদ্দেশ্য বুঝতে
পারলেন এবং সেই স্ত্রীকে তালাক দিলেন এবং নতুন আরেকজন কে বিয়ে করলেন ( অধিকাংশের মতে
তিনি ছিলেন জুরহুম কবীলার বয়োবৃদ্ধ সরদার মুজাজের মেয়ে)।
৩য়
বার-এবারও মক্কায় ইসমাইল আঃ ছিলেন না, তাই তিনি ফিলিস্থিন ফিরে এলেন। ফিরে আসার আগে ইব্রাহিম আঃ তার পুত্রবধুকে তাদের
অবস্থা সম্মন্ধে জানতে চাইলে পুত্রবধু আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তখন
নবী ইব্রাহীম আঃ বলে আসলেন ইসমাইল আসলে বলবেন যে তার পিতা তার ঘরের চৌকাঠটি শক্তভাবে
ধরে রাখতে বলেছেন।
চতুর্থ
বার- এবার যখন ইব্রাহীম আঃ এলেন দেখলেন ইসমাইল আঃ যমযম কুপের কাছে একটি গাছের নিচে
বসে তীরের শলাকায় শাণ দিচ্ছেন। পিতাকে দীর্ঘদিন পরে দেখে আবেগ- আপ্লূত হয়ে যা করা প্রয়োজন
তাই করলেন। এইবারেই পিতা-পুত্র মিলে বাইতুল্লাহ (কাবা) নির্মাণ করলেন। কাবার ভিত উচু
করলেন এবং পৃথিবীর সর্বত্র সকল মানুষের কাছে বায়তুল্লাহর হজ্জের ঘোষনা দিলেন।[৭]
[
ধারাবাহিকভাবে চলবে ইনশাল্লাহ]
টীকা- ১। সুরা
-ফাজর, আয়াত
: ৬-৮ তে ও অন্যান্য অনেক সুরাতে আদ জাতির কথা এসেছে। আর তাদের নবী
ছিলেন হুদ আঃ। ২।সুরা: আরাফ,
আয়াত: ৭৩-৭৬ তে ও অন্যান্য অনেক সুরাতে সামুদ জাতির কথা এসেছে।আর তাদের নবী ছিলেন
সালেহ আঃ। ৩। কোরান পাকে ও জুরহুমি দের কথা
এসেছে ৪। (সুরা সাবা ১৫ নং আয়াত) । এ বংশটি মুলতঃ ইয়েমেনের সাবার রানী বিলকিসের
বংশধারা যিনি নবী সুলাইমান আঃ এর চিঠি ও দাওয়াতের মাধ্যমে মুসলমান হয়েছিলেন। ৫। সুরা সাফফাত : আয়াত
১০৬ঃ “নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।“ ৬। শেষ ৩ বার ইব্রাহীম আঃ এর মাক্কায় আগমন ঈমাম বুখারি রঃ, হযরত ইবনে আব্বাস
রাঃ এর হাদীস থেকে বর্ণনা করেন । ৭। হাদীস নং ৩৩৬৪, ৩৩৬৫, কিতাবুল আম্বিয়া, সহীহ বুখারী। |
কিছুটা এডিট করতে হবে- পর্যালোচক
ReplyDelete